দীর্ঘ নয় মাস এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, বাঙালি জাতি অর্জন করে তার বহু প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা। প্রায় দুই শত বছর ধরে ইংরেজ দাসত্বের শিকল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও যে স্বাধীনতা ছিলো আরাধ্য, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দুই দশকের পাকিস্তানি অত্যাচারী শাসনের অবসানের মাধ্যমে সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হই আমরা, বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। যাদের আত্মত্যাগের কারণে বাংলাদেশের এই চূড়ান্ত অর্জন, প্রিয় স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া- 'ইকোনমিক্স ক্যারিয়ার অ্যালায়েন্স' শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে আমাদের সেই মহান স্বাধীনতাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। তাঁদের ত্যাগ ও তিতিক্ষার অভূতপূর্ব প্রদর্শন ও দেশাত্মবোধের চেতনাই আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
সুদীর্ঘ চব্বিশ বছরের পাকিস্তানি দুঃশাসনে, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে শোষণ, বঞ্চনা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষপাতী আগ্রাসনের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জীবনযাত্রার মান ছিলো খুবই নিম্ন মানের। পাকিস্তানি শাসকেরা আমাদের সকল অধিকার খর্ব করে আমাদের অবহেলা ও বঞ্চনার ভীড়ে একটা পরাধীনতার অদৃশ্য শিকল পড়িয়ে রেখেছিলো। আজকের আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যখনই এই শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়েছে, প্রতিবারই তাঁদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে পুলিশি নির্যাতনের মাধ্যমে ভেস্তে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। পাশাপাশি পাকিস্তান সরকার ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৬৬'র স্বাধিকার আন্দোলন কিংবা ৬৯'র গণঅভ্যুত্থানে আপামর বাঙালির উত্তাল স্রোত সামলাতে না পেরে উল্টো বাড়িয়ে দিয়েছিলো শোষণের মাত্রা। তারা ৭০'র নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত সরকারকে হেনস্থা করে জনগণের হয়ে কথা বলার সুযোগ দেয় নি, বরং আলোচনার নামে টালবাহানা করা শুরু করে জনপ্রতিনিধিদের সাথে। এভাবেই বাংলার মানুষের প্রতিবাদ চিরতরে বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলো আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের সরকার।
অবশেষে বাঙালি যখন মু্ক্তির আকাঙ্ক্ষায় চরম পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত, আত্মত্যাগের সিদ্ধান্তে অটল- তখনই বাঙালির স্বাধিকার চেতনাকে চিরতরে দমিয়ে ফেলতে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে নিরীহ-নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর রক্তপিপাসু সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয় পাকিস্তানি সরকার। মানুষ কিছু টের পাবার আগেই পূর্ব পাকিস্তান পরিণত হয় শ্মশানে।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে, বঙ্গবন্ধু পাক সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার পূর্বে ঘোষণা করেন স্বাধীনতা। তাঁর নির্দেশমতো ঘরে ঘরে গড়ে ওঠে দুর্গ। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকসহ সকল শ্রেণির মানুষ এক কাতারে স্বাধীনতা সংগ্রামের যুদ্ধে নেমে পড়ে। বাংলার বীর সন্তানেরা স্বাধীনতার জন্য, দেশমাতার সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে দলে দলে যুদ্ধে যোগ দেয়। পুরো দেশব্যাপী পাকিস্তানি হানাদারদের বিপক্ষে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাসের কঠিন সংগ্রামের পর, হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা যখন মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে দিশেহারা, তখন তাঁরা দিগ্বিদিক হারিয়ে আত্মসমর্পণ করে মুক্তিবাহিনীর কাছে। ১৯৭১ সালের ১৬ডিসেম্বর, আজকের এই দিনে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল নিয়াজির সাথে হাজার হাজার পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে অর্জিত হয় আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বর তাই বাঙালিদের জন্য একটি আবেগ ও গর্বের দিন, বুকভরে স্বাধীনতার স্বাদ নেয়ার দিন।
যে স্বাধীনতার জন্য বাঙালির এতো আত্মত্যাগ, এতো সংগ্রাম- সেই স্বাধীনতাকে যুগে যুগে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলো শকুনের মতোন ধেয়ে আসা বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদে বলীয়ান মানুষের কারণে তা কখনোই সক্ষম হয় নি। তাই প্রতিবছর আমাদের মহিমান্বিত বিজয় দিবস, '১৬ ডিসেম্বর' আমাদের বুক চিতিয়ে স্বাধীনতার সম্মান অক্ষুন্ন রাখার শিক্ষা দেয়। এই শিক্ষা নিয়েই আমাদের উচিত স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে স্ব স্ব অবস্থান থেকে দেশ বিনির্মাণে এগিয়ে আসা এবং জাতিকে একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।